করোনা ও তার ভ্যাকসিন
নোভেল করোনাভাইরাস....
যে ভাইরাস আতঙ্ক আজ সারা বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশ কে এক বিশাল ভয় এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
পৃথিবীর ১৪৫ টার বেশি দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে যার মধ্যে ভারতও রয়েছে।
এমতাবস্থায় আমেরিকার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস এর উপর লাগাম লাগানোর জন্য প্রথম ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছেন।
আমেরিকান বিজ্ঞানীরা এই ভ্যাকসিন কে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে আমেরিকার সিয়াটেলে বসবাসকারী জেনিফার হলার নামে এক মহিলার শরীরে তা প্রয়োগ করেন।
এখন বিজ্ঞানীরা এই ভ্যাকসিনের অ্যাকশন বা শক্তি ক্ষমতা কতটা সেদিকে নজর রেখেছেন৷
বিজ্ঞানীদের কে এখন সবার প্রথমে এটা প্রমাণ করতে হবে যে করোনা প্রতিরোধে এই টিকা সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত এবং তা সফলতার সাথে করোনার সংক্রমণকে আটকাতে পারে।
ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার কাজ যদি সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েও যায় তবুও তা বাজারে আসতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে কারণ এই টিকার প্রভাব কতটা দীর্ঘস্থায়ী তা বুঝতে বেশ কয়েক মাস মাস সময় লেগে যাবে।
এই পরীক্ষার জন্য ১৮ থেকে ৫৫ বছর বছর বয়সী ৪৫ জন সুস্থ মানুষকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
এবং এদের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করার পর আগামী ৬ সপ্তাহ ধরে দেখা হবে এই টিকার প্রভাব ঠিক কতটা৷
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ এখনও তা একইভাবে অব্যাহত৷ আর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ঘাতক করোনা ভাইরাসের হাত থেকে মোকাবিলা করার উপায় খুঁজতে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সবাই এক হয়ে কাজ করছেন৷
অনেক দেশ ইতিমধ্যেই এই ভ্যাকসিন তৈরির ক্লিনিকেল ট্রায়ালের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু করে দিয়েছে৷
আমি জানি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন কে নিয়ে অনেকজনের মনে অনেক প্রশ্ন আছে.....
যেমন, ভ্যাক্সিন কি জিনিস? ভ্যাক্সিন কারা বানায়? ভ্যাক্সিন কিভাবে কাজ করে? এবং সবথেকে বড় প্রশ্ন ভ্যাক্সিন তৈরিতে এত সময় কেন লাগছে.….?? অথবা এই ভ্যাক্সিন তৈরিতে আর কতো সময় লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি.....
পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এবং ল্যাব এই ভ্যাকসিন তৈরিতে লেগে আছে কারণ এই নতুন উদ্ভূত মহামারীর কোন টিকা কিংবা নির্দিষ্ট কোন ওষুধ এখনো পর্যন্ত নেই।
সবার প্রথমে আমি ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে একটা প্রাথমিক ধারণা দিই তা হলো....
ভ্যাক্সিন ভাইরাস কে মারে না....
ভাইরাস কে আমাদের শরীর ই মারে৷
ভ্যাকসিন কেবলমাত্র আমাদের শরীর কে সেই ভাইরাসের সাথে লড়ার জন্য রেডি করে৷
আর যেকোন ভাইরাসের ভ্যাকসিন হলো সেই ভাইরাসের ই মৃত অথবা দুর্বল স্যাম্পল, যে স্যাম্পেল থেকে আমাদের শরীর বুঝতে পারে সেই ভাইরাস টা কেমন এবং তার সাথে কিভাবে লড়তে হবে৷
যদিও এখানে একটা বড় ঝুঁকি থাকে৷
যদি ভুলেও ভাইরাসের সেই স্যাম্পল শরীরে ছড়াতে থাকে এবং সেখানে গিয়ে অ্যাক্টিভেট হয়ে যায় তাহলে সর্বনাশ নিশ্চিত৷
এইজন্য খুব সাবধানে এবং নিপুণ ভাবে ভ্যাকসিন তৈরি করতে হয়৷
ভ্যাকসিন তৈরি করতে ভাইরাসের এমন স্যাম্পল চাই যাতে করে আমাদের শরীর সেই ভাইরাসের স্যাম্পেল কে চিনতে পারে এবং তা আমাদের শরীরের জন্য বিপদজ্জনকও না হয়। তার সাথে সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হয় যাতে তার কোনো সাইড এফেক্ট না থাকে।
আর এসব করতে গিয়ে অনেক বেশি সময় লেগে যায়।
সাধারণত মানুষের ওপর বেশিরভাগ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ পশুদের উপর সেই টিকার প্রভাব এবং সেফটি কতটা তা দেখার পর করা হয়।
কিন্তু এখন বর্তমানে নতুন তৈরি হতে থাকা করোনা ভাইরাসের এই টিকার Phase 1 এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ পশু এবং মানুষের উপর একসাথেই করা হচ্ছে।
যেখানে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া তে অবস্থিত Inovio pharmaceuticals কোম্পানি আগামী এপ্রিলে এই ভ্যাকসিনের Phase 1 এর পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করবে মানুষের ওপর৷
এক্ষেত্রে বলে রাখি যে Inovio pharmaceuticals এ তৈরি হতে থাকা টিকার প্রয়োগ এর আগে ইঁদুর এবং শুয়োরের ওপর করা হয়েছে৷
যার পর দেখা গেছে ভাইরাসের প্রতি এদের অ্যান্টিবডি এবং t cell তৈরি হয়েছে৷
এখন এর এর প্রয়োগ বাঁদরের উপর করা হচ্ছে। যার পরেই বোঝা যাবে তারা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত এবং কার্যকরী নাকি নয়।
আমেরিকার National Institute of Allergy and Infectious Diseases সেখানকার সবচেয়ে নামী ইনস্টিটিউট।
৩ রা মার্চ ২০২০ তে এই ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর আমেরিকান সেনেটের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁকে জানান এই ভ্যাকসিন বাজারে আসতে দেড় বছর সময় লাগবে।
এই মুহুর্তে করোনা ভাইরাসের সমস্যায় জর্জরিত সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এই সময়টা অনেক বেশি মনে হলেও আদতে তা অনেক কম।
কারণ বেশিরভাগ ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে বাজারে আসতে দশ থেকে পনেরো বছর সময় নেয়।
এখন প্রশ্ন হলো এতো সময় কেন লাগে?
এর উত্তর হলো এর পেছনে রয়েছে ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট এর অনেকগুলো স্টেজ।
আমি এখানে ভ্যাকসিন ডেভলপমেন্ট স্টেজ এবং ভ্যাকসিন তৈরিতে লাগা কমপক্ষে সময় বলছি বাকিটা কমবেশি নিজেরা একটু হিসেব করে দেখে নেবেন।
1/ Discovery :- ভ্যাকসিন তৈরীর এই পর্যায়ে ল্যাবে সবার প্রথমে সেই ভাইরাসের ই মৃত অথবা দুর্বল ভাইরাস কে তৈরি করতে হয়। এটা করতে গিয়ে অনেক বছর সময় লেগে যায় কিন্তু বর্তমানে উন্নত টেকনোলজি হওয়ার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই এটা হয়ে যায়।
করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে কিছু কিছু দেশ এই পর্যায় টা জানুয়ারি মাসেই কমপ্লিট করেছিল।
2/ Clinical trial :- ভ্যাকসিন তৈরীর ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়৷
এই পর্যায়ে মানুষের ওপর ভ্যাকসিন কে প্রয়োগ করা হয় এর জন্য ভলেন্টিয়ার জোগাড় করতে হয়।
ভাইরাসের রিস্ক কে খেয়াল রেখে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনেকগুলো পর্যায়ে সম্পন্ন হয়।
তাই এবার ভলেন্টিয়ারের প্রকার, ভলেন্টিয়ারের সংখ্যা এবং এসব করতে গিয়ে লাগা সময় গুলো খেয়াল করুন...
Phase 1 সবার আগে এক ডজন মানুষের ওপর ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করা হয় এবং এরা প্রত্যেকেই সুস্থ সবল হওয়া আবশ্যক।
এটা সম্পুর্ণ হতে 3 মাস সময় লাগে৷
যদি এই পর্যায়ে তে কারো কোন সমস্যা বা সাইড এফেক্ট না হয় তাহলে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ
Phase 2 :– এই পর্যায়ে তে কয়েকশো ভলেন্টিয়ার কে টিকা দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে তে থাকা সমস্ত ভলেন্টিয়ার কে ভাইরাস সংক্রমিত অঞ্চল বা এলাকা থেকেই নিয়ে আসা হয়।
এই পর্যায় সম্পূর্ণ হতে ছয় থেকে আট মাস সময় লাগে। এখানেও যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে শুরু হয় পরের পর্যায় অর্থাৎ
Phase 3 :- এই পর্যায়ে তে কয়েক হাজার ভলেন্টিয়ার কে খুজে বের করা হয় এবং সেটাও ভাইরাস সংক্রমিত এলাকা থেকেই। এই পর্যায়ে তেও যদি কোন সমস্যা না হয় তাহলে তা পরের পর্যায়ের দিকে এগোয় অর্থাৎ
Phase 4 : এই পর্যায়ে তে আগের তিনটি পর্যায়ে হওয়া পরীক্ষার সমস্ত ডাটা কোন ড্রাগ রেগুলেটারি বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়৷
এক্ষেত্রে আমাদের দেশ ভারতে Central Drugs Standard Control Organization রয়েছে৷
অন্যদিকে আমেরিকা তে রয়েছে Us food and drug administration নামে সংস্থা ৷
যারা ঠিক করে কোনো ভ্যাকসিন কে অ্যাপ্রুভ করা হবে নাকি হবে না।
এটা করতে বেশ কয়েক মাস কিংবা বছর সময় লেগে যায় এরপর তৈরি হওয়া ভ্যাকসিনের ম্যানুফ্যাকচারিং করা হয় এবং তারপর বাজারে ছাড়া হয়৷
তাই ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে করনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন এর ক্ষেত্রে লাগা দেড় বছর সময় টা খুব বেশি নয়, বরং অনেকবেশী কম।
করোনার ভ্যাকসিন এর চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি তৈরি করতে গেলে রিস্ক নেওয়া হয়ে যাবে আর তখন একটা মহামারী কে তাড়াতে গিয়ে আরেকটা মহামারী সারাবিশ্বে ছেয়ে যাবে।
Comments
Post a Comment