পবিত্র শালগ্রাম শিলা নিয়ে কিছু কথা
ওপরের ছবিটি পবিত্র শালগ্রাম শিলার।
এই শিলা সৃষ্টির পিছনে পুরাণের একটি কিংবদন্তি আছে।
শিব পুরাণ' এবং 'দেবী ভাগবত পুরাণে' বর্ণিত কাহিনী অনুসারে একবার "দেবরাজ ইন্দ্র মহাদেবের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে কৈলাস পর্বতে আসছিলেন"। এই সময় মহাদেব ইন্দ্রের ধৈর্য পরীক্ষা করার জন্য 'অঘোরি রূপে' কৈলাসের পথে শুয়ে পড়লেন। ইন্দ্র 'অঘোরি' রূপে শিব কে দেখে চিনতে না পেরে তাকে পথ থেকে সরে যেতে আদেশ দিলেন, কিন্তু অঘোরি একটুও নরলেন না। বারবার বলার পরেও তখন অঘোরি সরলেন না তখন ইন্দ্র তাকে বলপূর্বক সরাতে চাইলেন। কিন্তু ইন্দ্রের সকল প্রকার অস্ত্র-শস্ত্র তার সামনে ব্যার্থ হয়, যার ফলে ইন্দ্র ক্রোধিত হয়ে বজ্র দ্বারা শিবের মস্তকে আঘাত করলেন। এতে মহাদেব ক্ষুব্ধ হয়ে তৃতীয় নয়ন দ্বারা ভষ্ম করতে উদ্যত হলে ইন্দ্র তাকে চিনতে পেরে শিবের সরনাপন্ন হলেন। এতে মহাদেব ইন্দ্রকে ক্ষমা করলেন এবং তার ক্রোধাগ্নি 'সমুদ্রে' নিক্ষেপ করলেন।
শিবের ক্রোধাগ্নি সমুদ্রে গিয়ে মিলিত হলে তার থেকে এক শিশুর জন্ম হয়। 'দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য' এই শিশুর পালনের দায়িত্ব নিলেন। যেহেতু জল তাকে ধারন করছিল তাই তার নাম হয় 'জলন্ধর'।
জলন্ধর মহাদেবের অংশ হওয়ার কারনে তার মতো সর্বগুনসম্পন্য ছিল, তাকে দেখলে মনে হতো সামনে যেন সাক্ষাত মহাদেব দাড়িয়ে আছেন। সেই কারনে দৈত্যগুরু তাকে অসুররাজ নিযুক্ত করলেন,
পরে 'কালনেমী অসুরের' কন্যা 'বৃন্দার' সাথে তার বিবাহ হয়।
জলন্ধর 'পরমপিতা ব্রহ্মার' তপস্যা করে বরদান লাভ করে, "তার পত্নীর সতীত্ব যতদিন অক্ষুন্ন থাকবে ততদিন জলন্ধর অবধ্য এবং অজেয় হবে"।
ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে জলন্ধর ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে ওঠে, যার ফলে দেবগণ স্বর্গচ্যুত হয়। ক্ষমতা পেয়ে সে ঋষি-মুনি এবং সমগ্ৰ মানবজাতির ওপর অত্যাচার শুরু করে। তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সকল দেবতা এবং ঋষিগণ 'ভগবান শরণাপন্ন হলেন।
কিন্তু "জলন্ধর সমুদ্রে জন্মগ্ৰহন করার কারনে ছিলেন দেবী লক্ষ্মীর ভাই, এছাড়া জলন্ধর পত্নী বৃন্দা পরম পতিব্রতা এবং ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত"। এই সকল কারন বসত ভগবান বিষ্ণু জলন্ধরের বধ করবেন না।
এতে সকলে হতাশ হয়ে প্রস্থান করলেন। এর কিছু সময় পর একদিন 'নারদ মুনি' জলন্ধরের সমক্ষে উপস্থিত হলে জলন্ধর তাকে জিজ্ঞেস করেন "জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী কে"?
নারদ মুনি উত্তরে বললেন মহাদেবের অর্ধাঙ্গিনী 'দেবী পার্বতী' জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী। এতে জলন্ধর কৈলাসে দুত পাঠিয়ে দেবী পার্বতীকে "শিব এবং কৈলাস ছেড়ে তার পত্নী হওয়ার প্রস্তাব দেয়" কিন্তু দেবী পার্বতী এতে ক্ষুব্ধ হলেন যার ফলে দুত ভয় পেয়ে জলন্ধরের কাছে ফিরে যায়। জলন্ধর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মহাদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং কৈলাস আক্রমণ করে। এরফলে মহাদেবের সাথে তার প্রলংকারি যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু "ব্রহ্মার বরদানের কারনে যতক্ষন বৃন্দার সতীত্ব অক্ষুন্ন আছে ততক্ষন জলন্ধরের বধ সম্ভব নয়"।
জলন্ধরের বধ যখন স্বয়ং মহাদেবের কাছেও প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে তখন সর্বদেব একত্রিত হয়ে পুনরায় 'ভগবান বিষ্ণুর' সরনাপন্ন হলেন।
বৃন্দা ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত তাই একমাত্র ভগবান বিষ্ণুই পারেন বৃন্দার সতীত্ব ভঙ্গ করে জগতের উদ্ধার করতে।
দেবতাদের প্রার্থনা শুনে "ভগবান বিষ্ণু জলন্ধরের রূপ ধারণ করে বৃন্দার কাছে গেলেন"।
এদিকে বৃন্দা তার স্বামী কে "মহাকালের প্রকোপ থেকে সুরক্ষিত" ফিরে আসতে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন এবং তাকে আলিঙ্গন করলেন।
"বৃন্দা এক পরপুরুষ কে নিজের পতি ভেবে আলিঙ্গন করলেন এতে তার সতীত্ব কিছুটা হলেও ভঙ্গ হলো", যার ফলে জলন্ধরের বধ এবং মহাদেবের বিজয় সম্ভব হয়।
কিন্তু বৃন্দা আলিঙ্গন করা মাত্রই বুঝতে পারলেন যে ইনি তার পতি নন, ইনি অন্য কেউ।
এতে বৃন্দা ক্ষুব্ধ হয় এবং তাকে প্রকৃত রূপে আসতে বলেন। ভগবান বিষ্ণু যখন নিজের প্রত্যক্ষ রূপ ধারণ করলেন তখন তা দেখে যেন বৃন্দার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
"যে ভগবানের আরাধনা সে সারাজীবন নিঃস্বার্থ ভাবে করে এসেছে সেই ভগবান কিনা তার সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলেন"। বৃন্দা অত্যন্ত ক্ষোভ এবং দুঃখের সাথে বললেন, "এমন কার্য তো কোনো পাষাণ হৃদয় ব্যাক্তিই করতে পারে, তো হে নারায়ণ আপনি সেই পাষাণেই পরিনত হবেন"। এই বলে বৃন্দা অগ্নি সংযোগ করে তাতে নিজের প্রাণের আহুতি দিয়ে দিলেন এবং আগুনে জ্বলতে জ্বলতে তিনি বললেন, "আমার মৃত্যুর পর আমার স্বামী এসে হয়তো আমায় পাগলের মত খুঁজবেন,
তো হে নারায়ণ এমন সময় আপনারো আসবে যখন আপনিও আপনার পত্নিকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াবেন"।
ভগবান বিষ্ণু সবটা শুনলেন এবং তিনি বললেন, "আমি তোমার সাথে কোনো ছলনা করিনি, বরং আমিতো তোমার স্বামীকে মোক্ষ দান করছি।
সে মহাদেবের অংশ ছিল এবং পুনরায় সে মহাদেবে মিলিত হয়েছে।
জলন্ধর জন্মজন্মান্তরের চক্র থেকে চিরতরে মুক্তিলাভ করেছে এবং আজ থেকে সে মহাদেবের তৃতীয় নেত্রে বাস করবে।"
ভগবান বিষ্ণুর কথা শুনে বৃন্দার অনুশোচনা হয় এবং সে প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে গেলে প্রভু বলেন, "তোমার অনুতপ্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই, তুমি সর্বদা নিজের পত্নী ধর্ম পালন করেছ এবং আমার প্রতি তোমার ভক্তিতেও কোনো ক্ষুত নেই। তোমার কারনে আজ সম্পুর্ণ জগত আমার এক নতুন রূপের দর্শন লাভ করতে চলেছে, আজ থেকে আমার এক রূপ জগতে শালগ্ৰাম শিলা রূপে পূজিত হবে। তোমার দ্বিতীয় অভিশাপও আমি গ্রহন করলাম, ত্রেতাযুগে আমি যখন রাম রূপে অবতীর্ণ হবো তখন আমার পত্নী হরন হবে এবং তোমার কথা মতো আমি তাকে পাগলের মতো খুজবো। তুমিও অমর হয়ে যাবে, তুলসী গাছ রূপে তোমার পুনর্জন্ম হবে এবং তোমাকে ছাড়া আমি কখনো পূজা গ্ৰহন করবো না"।
এতটা বলে ভগবান বিষ্ণু অন্তর্ধ্যান করলেন। বৃন্দার দেহ ভষ্মীভুত হলে তার "ভষ্ম থেকে তুলসী গাছের উৎপত্তি হয় এবং ভগবান বিষ্ণু শালগ্ৰাম রূপে তুলসীর ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হলেন"।
এই ঘটনার কয়েক লক্ষ বছর পরে ভগবান বিষ্ণু 'শ্রীকৃষ্ণ' রূপে অবতীর্ণ হবেন। তখন তার লীলাক্ষেত্র সাজানোর দায়িত্ব এই বৃন্দা নিয়েছিলেন।
তার নামানুসারে সেই লীলাক্ষেত্রের নাম হয় 'বৃন্দাবন' অর্থাৎ 'তুলসীর বন'।
বৃন্দার তুলসী রূপে জন্মগ্ৰহন করার পেছনেও আরো একটি কারন ছিল।
বৃন্দা যখন নবযৌবনা তখন তিনি একবার 'গনেশ' কে দেখে মোহিত হয়ে তাকে বিবাহ করতে চাইলেন, কিন্তু গনেশ তাকে জানান যে তিনি চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গনেশ তাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করায় তিনি ক্রোধিত হয়ে গনেশ কে অভিশাপ দিলেন, "গনেশের দুজন পত্নী হবে"। অকারনে অভিশাপ পেয়ে গনেশও ক্রোধিত হন এবং তিনিও বৃন্দা কে অভিশাপ দিলেন। তিনি বললেন, "তুমি গাছ রূপে জন্ম নেবে এবং আমার পূজায় চিরকালের জন্য বর্জিত থাকবে"।
গনেশের এই অভিশাপ ভগবান বিষ্ণু বরদানে পরিনত করলেন। ভগবান বিষ্ণু এবং তার অবতারগন তুলসীপত্র ছাড়া পূজা গ্ৰহন করেন না, কিন্তু গনেশ নারায়ণ অংশে জন্মগ্ৰহন করা সত্ত্বেও তার পূজায় তুলসী চিরবর্জিত। বৃন্দার অভিশাপে গনেশের দুই বিবাহ হয়, গনেশের দুই পত্নির নাম - 'সিদ্ধি ও বুদ্ধি'।
ভালো লাগলে শেয়ার করবেন এই অনুরোধ রইলো।
নতুন বছর সবার ভালো কাটুক ভগবান শ্রীবিষ্ণুর চরণে এই প্রার্থনা করি🙏🙏
Comments
Post a Comment